প্রান্তিক পর্যায়ে দেশের দারিদ্র বিমোচনের জন্য সরকার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) প্রতিষ্ঠা করলেও চাঁদপুরে তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে। এখানে গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠে একটি পারিবারিক সিন্ডিকেটে। যার কারণে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর এসব বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীন তদন্তে বেরিয়ে আসে।
প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত আছেন আবদুল গণি ও আফরোজা আক্তার দম্পত্তি। তারা উভয়ই পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকুরি পান বলে অভিযোগ আছে। এই দম্পত্তি সদর উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে নিজদের ব্যক্তিগত পারিবারিক বসতভিটি বানিয়ে রেখেছেন। যে কারণে তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠছেন তাদের আঙ্গুলের ইশারা ছাড়া কেউই সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করতে পারেনা।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে হিসাব রক্ষক পদে ২০১১ সাল থেকে কর্মরত রয়েছেন আবদুল গণি। তার স্ত্রী আফরোজা আক্তার উপজেলা সহকারী হিসাব রক্ষক পদে আছেন ২০১৫ সাল থেকে। একসঙ্গে এই দম্পত্তি প্রতিষ্ঠানটিতে থাকায় ইতোমধ্যে প্রায় ১১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ উঠে। একটি সমিতিকে ৩০ হাজার টাকার আসবাবপত্র দেয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেন হিসাবরক্ষক আব্দুল গণি। এছাড়াও অনিয়ম করে গণি-আফরোজা প্রতিষ্ঠানটির দোকান ও বাড়ি ভাড়া উত্তোলন করেন অনেকটা নিজদের মতো করেই। এসব তথ্য সংরক্ষিত। যদিও তারা এই প্রতিষ্ঠানের অনেক জরুরি কাগজপত্র গোপন করে রেখে নষ্ট হওয়ার কথা বলছেন।
এই দম্পত্তির বিরুদ্ধে রয়েছে প্রায় ১১ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ। যা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয় গণি-আফরোজার সাক্ষাৎকার, কর্মচারীদের লিখিত বক্তব্য ও পারস্পরিক পরিবেশ দৃষ্টে প্রতিয়মান হয় হিসাব রক্ষক আবদুল গণি কর্তৃক মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহারের নিকট হতে টাকা-পয়সা ধার নেয়া ও পরিশোধের ঘটনাটি সত্য।
৪৩ লাখ টাকা লোপাটে অভিযুক্ত মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহারের বক্তব্য থেকে জানাগেছে, হিসাবরক্ষক আবদুল গণি ও তার স্ত্রী হিসাব সহকারী আফরোজা বেগম ইউসিসিএলি কর্তৃক মধ্য মৈশাদী মহিলা সমবায় সমিতির ম্যানেজার রহিমা বেগমের নামে ৫০ হাজার টাকা ঋণ অনুমোদন করেন। যা আফরোজা বেগম নিয়েছেন এবং তা পরিশোধও করেছেন। এ বিষয়ে আফরোজা বেগম এর সাথে আলাপ করলে তিনি সত্যতা স্বীকার করেন।
তদন্ত কমিটি তদন্তে বেরিয়ে আসে-আবদুল গণি হিসাব রক্ষক পদে চাঁদপুর সদর উপজেলায় দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা ও সদর উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহারের সাথে বিধি বহির্ভূতভাবে অর্থ লেনদেনে জড়ায়। যা সঠিকভাবে তদারকি করেননি তৎকালীন উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবুল কাশেম খান। মূলত সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের হোতা আবুল কাশেম, আবদুল গণি ও আফরোজা। তারাই পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে সদর বিআরডিবি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তারা নিজেদের অনিয়ম গোপন করার জন্য চেষ্টা চালায়।
মাঠ সংগঠক ইকবাল বাহার তদন্ত কমিটির কাছে তার অভিযোগে দাবি করেন-হিসাব রক্ষক আবদুল গণিকে ৮ লাখ টাকা ও তার স্ত্রী হিসাব সহকারী আফরোজা বেগমকে ২ লাখ ২২ হাজার টাকা ধার প্রদান করে। অপরদিকে হিসাব রক্ষক মো. আবদুল গণি মহিলা উন্নয়ন অনুবিভাগের তহবিল হতে মধ্য তরপুরচন্ডি সমবায় সমিতির নামে ফার্নিচার দেয়ার জন্য সমিতির নামে ৩০ হাজার টাকার চেক ইস্যু করে। কিন্তু অদ্যাবধি সমিতিতে ফার্নিচার না দিয়ে টাকা আত্মাসাৎ করেন তিনি।
এমন অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে। যা প্রতিয়মান হয় আবদুল গণি ও আফরোজা আক্তার দম্পত্তি স্থানীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়িত্ব পালন করায় তাদের কাছে পুরো প্রতিষ্ঠানটি জিম্মি হয়ে পড়ে। যদিও ইতিমধ্যে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ আবুল কাশেম খান অবসরত্তোর ছুটিতে রয়েছেন। তিনিও প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতির আস্থানায় পরিণত করেন।
চাঁদপুরের স্থানীয় সমবায়ীরা দাবি করছেন, গণি ও আফরোজা আক্তার দম্পত্তির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। পাশাপাশি তাদের দুজনকে ভিন্ন কর্মস্থলে শাস্তিমূলক বদলির মাধ্যমে চাঁদপুর সদর বিআরডিবির স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
অভিযুক্ত আফরোজা আক্তার বলেন, ইকবাল বাহার আমাদের সাথে শত্রুতা করে এসব ঘটনায় জড়াচ্ছে। কারণ তার বিষয়ে আমরা কথা বলছি। ইকবাল টাকা খরচ করছে সে স্বীকার করছে। ইকবাল বাহারের সাথে আফরোজার ভাল সম্পর্ক থাকায় তার সব বিষয়ে জানিয়েছে। সে ওই টাকা কোন কোন স্থানে বিনিয়োগ করেছে। তবে এই লোপাটের টাকাগুলো ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বেশি তছরুপ হয়েছে।
মধ্য তরপুরচন্ডি সমবায় সমিতির নামে ফার্নিচার দেয়ার জন্য সমিতির নামে ৩০ হাজার টাকার আত্মসাতের বিষয়টি বক্তব্য জানতে চাইলে হিসাব রক্ষক আব্দুল গনি তা অস্বীকার করেন। ইকবাল বাহার থেকে টাকা নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, চোর যখন বাঁচতে চাইবে তখন অন্যদেরকে গায়েল করার চেষ্টা করে।
সাবেক সদর উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবুল কাশেম খান বলেন, ইকবাল বাহারের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আমি নিজেই প্রথম প্রদক্ষেপ নিয়েছি। এরপর তার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়। তাকে প্রশ্ন করা হয়, এর আগেও আপনি হিসাব রক্ষক হিসেবেও এই স্থানে দায়িত্ব পালন করেছেন তখন কেন ব্যবস্থা নেয়নি। এসব বিষয়ে তিনি সঠিক উত্তর দিতে পারেননি।